প্রচ্ছদ অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম যখন বিভ্রান্তির উৎস

প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম যখন বিভ্রান্তির উৎস

লিখেছেন Dewan Tahmid
51 ভিউ

গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর শিরোনাম, বিকৃত বক্তব্য, মিসফ্রেমিং ইত্যাদি প্রায়শই দেখা যায়। তবে সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কখনো কখনো একইদিনে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে একযোগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপতথ্য প্রচার করা হচ্ছে। গত দুই মাসে অন্তত ছয়বার এমন ঘটনা ঘটেছে।

 

গত ৪ জুন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে দেশের মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি সংগঠিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালানো হয়। ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন), ২০২৫’-এ মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, “শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার স্বীকৃতি বাতিল” কিংবা “মুজিবনগর সরকারের সব নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল” ইত্যাদি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হতে থাকে। সমকাল এই বিভ্রান্তিকর শিরোনামে প্রথম খবর প্রকাশ করে। পরে একই ধাঁচের সংবাদ দেখা যায় ইত্তেফাক, যুগান্তর, বিডিনিউজ২৪, আমাদের সময়, বাংলানিউজ২৪, ইনকিলাব, নিউজ২৪, এখন টিভি, বাংলা ট্রিবিউন, দৈনিক বাংলা, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, ঢাকা মেইল, ঢাকা পোস্ট, ঢাকা টাইমস২৪, খবরের কাগজ, দেশ টিভি, কালবেলাসহ একাধিক গণমাধ্যমে।

 

একই দিন করিডর বিষয়েও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের বক্তব্য বিকৃত করে অপপ্রচার চালায় বিভিন্ন গণমাধ্যম। গোয়েন লুইসকে উদ্ধৃত করে দৈনিক প্রথম আলো লেখে, ‘বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য করিডর প্রতিষ্ঠায় কাজ করছিল (বাংলাদেশ) সরকার। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘ জড়িত নয়।’ অথচ তিনি মূলত বলেছিলেন, “হিউম্যানিটারিয়ান করিডর একটি ফরমাল, লিগাল ইস্যু। এর জন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চুক্তি প্রয়োজন। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, এবং সম্ভাব্য যেসব গ্রুপ এতে জড়িত তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে একমত হতে হবে। যদি হয়, জাতিসংঘ তখন সাপোর্ট দিতে পারবে। কিন্তু সেই চুক্তি, আমি যতদূর বুঝি, এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে কোনো ধরনের আন্তসীমান্ত সম্পর্কের উন্নতি, সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করার জন্য যেকোনো উদ্যোগকে জাতিসংঘ স্বাগত জানায়। কিন্তু সেখানে হিউম্যানিটারিয়ান করিডর প্রতিষ্ঠিত হয় নি, এবং এরকম কোনো করিডর প্রতিষ্ঠা করার আলোচনায় আমরা যুক্ত হইনি।” ডয়েচে ভেলেও বিকৃত বক্তব্যসমেত একটি ফটোকার্ড পোট করে। প্রথম আলো ও ডয়েচে ভেলে পরে সংশোধন করে নেয়, যদিও তার আগেই এটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়ে যায়। পরে বাংলা ট্রিবিউন, মানবজমিন, বার্তা ২৪, এনটিভি ইত্যাদি গণমাধ্যমও এই অপপ্রচারে অংশ নেয়। সরকার মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছিল, কিন্তু এতে জাতিসংঘ জড়িত নয়, এমন একটি বয়ান তৈরির চেষ্টা করে এসব গণমাধ্যম। 

 

মে মাসে সরকার মেয়াদ ও অন্যান্য কারণে ৩টি দেশ থেকে রাষ্ট্রদূতদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এই তিন দেশের মধ্যে কেবল মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের খবর আলাদাভাবে প্রচার করে এবং এর সঙ্গে কথিত ‘মানবিক করিডর’-এর প্রসঙ্গ জুড়ে দিয়ে গত ২৭ মে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করে কালবেলা, কালের কণ্ঠ, ইনকিলাব, ঢাকাপোস্ট, আমাদের সময় ইত্যাদি গণমাধ্যম।

 

১২ মে তারিখে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের একটি বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে ব্যাপক অপপ্রচার চালায় কিছু গণমাধ্যম। ওই দিন ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, অভিযোগ হিসেবে “গণহত্যা” আছে কিনা। এর জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “বাংলাদেশের প্রচলিত ভাষায় যদি একসাথে বেশি মানুষ মারা যায় তাহলে আমরা বলি যে গণহত্যা হয়েছে। একসাথে অনেক মানুষ মারা গেছে এটাকে মাস কিলিং অথবা ম্যাসাকার বলতে পারেন, কিন্তু আইনের যেটা জেনোসাইড—সেটা কিন্তু এটা না।” কিন্তু এটিকেই বিকৃত করে “জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হয়নি: চিফ প্রসিকিউটর” শিরোনামে খবর ও ফটোকার্ড প্রচার করে আজকের পত্রিকা, সমকাল, ইত্তেফাকসহ নানান অনলাইন পোর্টাল।

 

গত ১৭ এপ্রিলে দিনাজপুরে ভবেশ চন্দ্র রায় নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অপতথ্য ছড়ানো হয়। ‘দিনাজপুরে স্থানীয় হিন্দু নেতাকে ‘অপহরণ করে পিটিয়ে হত্যা’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টার। ডেইলি স্টারের এই সংবাদের বরাতে দশটিরও বেশি ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন হিসেবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আজকের পত্রিকায় “দিনাজপুরে হিন্দু ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে পিটিয়ে হত্যা” শিরোনামে খবর প্রকাশ হয়। এসব সংবাদে ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার চেষ্টা ছিল। ডেইলি স্টার পরে তাদের প্রতিবেদন সংশোধন করে নেয় এবং স্বীকার করে যে নিশ্চিত না হয়েই তারা অপহরণ ও পিটিয়ে হত্যার মতো তথ্য প্রকাশ করেছিল, যার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। ২০ এপ্রিল বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নিহতের ছেলে স্বপন জানান, “তার বাবার মৃত্যু অস্বাভাবিক। তবে এটি অসুস্থ হয়ে নাকি আঘাতের মাধ্যমে সেটি এখনও নিশ্চিত নন। তিনি জানান, তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ তাদের কাছে নেই।” মৃত্যুর ঘটনাকে এখনো হত্যা বলতে নারাজ তার পরিবার। পুলিশের দাবিও ছিল, নিহতের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

 

এর আগে ১২ এপ্রিল সমাজকল্যাণ ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের উক্তিকে বিকৃত করে একযোগে অপপ্রচার চালায় বিভিন্ন গণমাধ্যম। ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এক স্মরণসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। তাঁদের সুস্থ করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খালি হাতে খালি পায়ে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। দেশটাও গত ৫০ বছরে গড়েই উঠল না। গণতন্ত্র, সাম্য, সমাজতন্ত্র, ন্যায়বিচার—সবই আড়ালে থেকে গেল। আমাদের রাজনীতি নিশ্চয় ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সেই রাজনীতি ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে।’ কিন্তু এটিকেই বিকৃত করে “একাত্তরের রাজনীতি ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে” শিরোনামে খবর প্রকাশ করে মূলধারার পত্রিকা যুগান্তর, জনকণ্ঠ, যায়যায়দিন, ইনকিলাব, এবং আরটিভি, একুশে টিভির মতো টিভি চ্যানেল ও দশের অধিক  নিউজ পোর্টাল। 

 

সাম্প্রতিক সময়ে একযোগে বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশের এই প্রবণতা নিছক দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক নয়, বরং কোনো নির্দিষ্ট বয়ান প্রতিষ্ঠার সংঘবদ্ধ চেষ্টা বলে প্রতীয়মান হয়। একইদিনে একযোগে প্রচারিত বিভ্রান্তিকর সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলোর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখানোর প্রবণতা ছিল। পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের চালানো হত্যাযজ্ঞ ও কথিত করিডর ইস্যুতে বিতর্ক তৈরির একটি সচেতন প্রচেষ্টাও লক্ষ করা যায়। গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রচার নতুন নয়, তবে একই সময় একাধিক প্রধান গণমাধ্যমে একই ধরনের বিভ্রান্তিকর বার্তা প্রকাশ একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা, যা নতুন মাত্রায় দেখা দিচ্ছে।

আপনি আরও পছন্দ করতে পারেন

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ‘বাংলাফ্যাক্ট’ পিআইবি’র ফ্যাক্টচেক, মিডিয়া রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস টিম, যারা নিয়মিত ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য যাচাই করে সত্য তুলে ধরে এবং গণমাধ্যম ও সংবাদ নিয়ে গবেষণা করে।

আমাদের ঠিকানা

৩, সার্কিট হাউজ রোড, ঢাকা ১০০০ 

কপিরাইট © বাংলাফ্যাক্ট 

এই ওয়েবসাইটে কুকি ব্যবহার করা হয়, যাতে আপনার ব্রাউজিং অভিজ্ঞতা আরও উন্নত করা যায়। আপনার সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে, তবে আপনি চাইলে এটি ব্যবহার না করেও ব্রাউজ করতে পারেন। অনুমোদন দিন বিস্তারিত দেখুন