| বিশ্লেষণ
বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, পত্রিকায় যেভাবে এসেছে
২ ডিসেম্বর ২০২৫
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় স্বাধীন কমিশন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৩০ ডিসেম্বর রবিবার তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান ও অন্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন।
বাংলাদেশের নয়টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এই সংবাদটি কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে—তা বিশ্লেষণ করেছে বাংলাফ্যাক্ট। বিশ্লেষণের জন্য যে পত্রিকাগুলো নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হলো প্রথম আলো, আমাদের সময়, সমকাল, যুগান্তর, বণিক বার্তা, দ্য ডেইলি স্টার, আজকের পত্রিকা, আমার দেশ ও কালের কণ্ঠ।
১ ডিসেম্বর ২০২৫-এ চয়নকৃত ৯টি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে যুগান্তর, ডেইলি স্টার ও কালের কণ্ঠ লিড নিউজ করেছে। বণিকবার্তা ও আজকের পত্রিকার সেকেন্ড লিড ছিল এটি। প্রথম পৃষ্ঠার লোয়ার ফোল্ডে খবরটিকে রেখেছে প্রথম আলো, আমাদের সময় ও সমকাল। সেদিন কোনো পত্রিকাই এ বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেনি। তবে পরদিন, ২ ডিসেম্বর, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ ও আমার দেশ এই বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
প্রতিবেদন উপস্থাপনার দিক থেকেও পত্রিকাগুলোর মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। আমার দেশ ও যুগান্তর তাদের সংবাদে শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করেছে। আমার দেশ ও আজকের পত্রিকা দিয়েছে তাপসের ছবি। অন্য সব পত্রিকাই ঘটনাটির প্রেক্ষাপট হিসেবে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ছবি ব্যবহার করেছে। পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বড় করে, ৫ কলামে ছাপিয়েছে আমার দেশ। বাকিগুলোর মধ্যে ৩ কলামে চারটি পত্রিকা ও ২ কলামে অন্য চারটি পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে।
সব পত্রিকার শিরোনামেই আওয়ামী লীগ জড়িত থাকার উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে ৬টি পত্রিকার শিরোনামে সরাসরি শেখ হাসিনার নাম আসে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া, তাপসের সমন্বয়ের ভূমিকা, তৎকালীন সেনাপ্রধানের আচরণ, ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা এবং কিছু গণমাধ্যমের অপেশাদারিত্ব—এসব বিষয়ও বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সংবাদ প্রতিবেদন
প্রথম আলোর ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডে আ.লীগ দলগতভাবে জড়িত’ শীর্ষক সংবাদে মূল সমন্বয়কারী শেখ ফজলে নূর তাপস এবং পুরো ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল- বলে সাব হেডে উল্লেখ করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনের বরাতে ভারতের জড়িত থাকা এবং কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে বলা হয়।
২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানেরা, এরকম একটা ফাইল ছবি যুক্ত করা হয়।
আমাদের সময় পত্রিকার ‘মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা, সমন্বয়কারী তাপস’ শীর্ষক সংবাদে হত্যাকাণ্ডে দলগতভাবে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা এবং মূল সমন্বয়কারী হিসেবে তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপসের কথা উল্লেখ করা হয়। হত্যাকাণ্ডে প্রতিবেশী দেশ ভারতের জড়িত থাকারও প্রমাণ, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পর্বতসমান গোয়েন্দা ব্যর্থতা, শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং সেনাবাহিনী, বিডিআরসহ অন্য বাহিনীগুলোকে দুর্বল করাই ছিল বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য। আর হত্যা ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের হাত থাকার বিষয়ও প্রতিবেদনে রয়েছে।
একজন নিহত বিডিয়ার জওয়ানকে জড়িয়ে ধরে স্বজনের কান্নার ফাইল ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
দৈনিক সমকাল ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সবুজ সংকেত দেন শেখ হাসিনা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে তাপসের ভূমিকা নিয়ে লেখা হয়। এ ছাড়া বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং কিছু গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের ভূমিকা অপেশাদার ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে তৎকালীন সেনপ্রধানের দায় ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নিয়েও লেখা হয়।
প্রতিবেদনের ভিতরে “সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিডিআর হত্যাকাণ্ড: তদন্ত কমিশন” শীর্ষক পয়েন্টে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ লেখা হয়।
যুগান্তরের শিরোনাম ছিল “বহিঃশক্তি ও আ.লীগ জড়িত”। খবরের সাথে হাসিনা, তাপস ও বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিনের ছবি দেয়া হয়। এছাড়া দ্বিতীয় পাতায় এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ছবি দেওয়া হয়। পুরো সংবাদ বিশ্লেষন করে দেখা যায়, প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনুস, কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব) আ ল ম ফজলুর রহমান, সদস্য জাহাঙ্গীর কবির তালুকদারের বক্তব্য উপস্থাপন করার মাধ্যমে প্রতিবেদনের সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে।
সংবাদের শিরোনামে ও মূল প্রতিবেদনে বহিঃশক্তির জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করলেও কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আওয়ামী লীগ নেতারা আশ্র্রয় দেওয়া ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের দায় থাকার কথা, ঘটনার সময় কিছু প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও কয়েকজন সাংবাদিকের ভুমিকা অপেশাদার ছিল, ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়।
বণিকবার্তা “বিডিআর হত্যাকাণ্ডে দলগতভাবে জড়িত আওয়ামী লীগ, মূল সমন্বয়কারী তাপস” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে। শোল্ডারে লিখেছে, “প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের প্রতিবেদন জমা”। প্রতিবেদনে কমিশন প্রধানের বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরা হয়। সেনাপ্রধান ও ভারতের ভূমিকা এসব বক্তব্যে উঠে আসে।
ডেইলি স্টার উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে ‘Hasina, AL leaders behind BDR mutiny’ শিরোনামে লিড নিউজ করেছে। সাবহেড ও প্রতিবেদনের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড থেকে ভারত “উপকৃত” ছিল বলে তদন্ত কর্মকর্তার বরাতে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনেও আওয়ামীলীগ ও তৎকালীন সেনাপ্রধানের ভূমিকা বিষয়ে তদন্ত কমিশনের বরাতে উদ্ধৃতি দেয়া হয়।
দৈনিক আজকের পত্রিকার শিরোনাম ছিল “প্রধান সমন্বয়ক তাপস, গ্রিন সিগন্যাল দেন শেখ হাসিনা”। এতে তাপসের ছবি দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল, তদন্ত কমিশনের এই ভাষ্যটি আজকের পত্রিকা’র প্রতিবেদনে গুরুত্ব পায়।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়ে আজকের পত্রিকার প্রতিবেদনে কিছু লেখা হয়নি।
কালের কণ্ঠ “হাসিনাসহ ভারতীয়রা জড়িত” শিরোনামে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাবহেডে লিখেছে, দলগতভাবে জড়িত আ. লীগ, মূল সমন্বয়কারী ছিলেন তাপস, জেনারেল মইনেরও দায় আছে। প্রধান উপদেষ্টা ও তদন্ত কমিশনের বিভিন্ন সদস্যবৃন্দের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হয়। এসব বক্তব্যে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ, আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা ও ভারতের ভূমিকা উঠে আসে।
আমার দেশ “ভারত আ.লীগ হাসিনা জড়িত তাপস মূল সমন্বয়কারী” শিরোনামে ৫ কলাম জুড়ে খবর প্রকাশ করেছে। ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে পত্রিকাটি লিখেছে, “ঘটনায় ভারতের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণও পাওয়া গেছে। দেশটির হুমকির কারণে ঘটনার পর পিলখানায় অভিযান পরিচালনা করা যায়নি।”
অন্যান্য পত্রিকা তদন্তে উঠে সাংবাদিকদের অপেশাদার আচরণের কথা উল্লেখ করলেও, আমার দেশ আরেকটু বিস্তারিতভাবে লিখেছে, “প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জঙ্গিতত্ত্ব আবিষ্কার করেছিল। সাংবাদিক মুন্নি সাহা, জ ই মামুন ও মনজুরুল আহসান বুলবুলের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে।”
সম্পাদকীয়
২ ডিসেম্বর যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, ও আমার দেশে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
দৈনিক যুগান্তর “তদন্ত কামশনের রিপোর্ট: পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আলোর দিশা” শিরোনামে সম্পাদকীয় ছেপেছে। এতে মন্তব্য করা হয়েছে, “জাতি দীর্ঘদিন ধরে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের সত্য জানতে উদগ্রীব ছিল। মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের প্রতিবেদন সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে।” এ ছাড়াও তদন্ত কমিশন ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে ভারতের কাছে জবাব চাওয়ার যে সুপারিশ করেছে, তা “তদন্তের স্বার্থে যথার্থই” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়নের উপর জোর দেয়া হয় সম্পাদকীয়তে।
কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়র শিরোনাম “প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি হোক”। এতে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, “আমরা আশা করি, জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পিলখানায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত দোষীদের দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে আনা হবে এবং বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে।”
আমার দেশ পত্রিকা “বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িত ভারত-আওয়ামী লীগ: এবার জড়িতদের বিচার করতে হবে” এমন শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এতে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, “বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সাহসী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ভয়াবহতম গণহত্যা সম্পর্কে জাতির মনে যেসব প্রশ্ন ছিল, তা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।” পাশাপাশি জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয় সম্পাদকীয়তে।
Topics:
যুবদল নেতা হত্যার ঘটনাকে ভারতীয় মিডিয়ায় হাসিনার রায় পরবর্তী সহিংসতা হিসেবে প্রচার
Indian media frames the murder of a Jubo Dal leader as post-verdict violence following Hasina’s sentencing
ইন্টারনেটে আগুন সন্ত্রাসের নির্দেশনা ও উষ্কানি দিচ্ছে আওয়ামী লীগের এক্টিভিস্টরা
AI-Generated Online Content
Targeting Political Parties, Government, and Security Forces
বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে পাসপোর্ট সূচকের খবর
আপনার মতামত দিন
এই পোস্টটি কি আপনার জন্য সহায়ক ছিল?
50%
50%
আপনার মতামত শেয়ার করুন:
| মন্তব্য সমূহ:
এখনও কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্যটি করুন!
বিশ্লেষণ
বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, পত্রিকায় যেভাবে এসেছে
২ ডিসেম্বর ২০২৫
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় স্বাধীন কমিশন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৩০ ডিসেম্বর রবিবার তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান ও অন্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন।
বাংলাদেশের নয়টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এই সংবাদটি কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে—তা বিশ্লেষণ করেছে বাংলাফ্যাক্ট। বিশ্লেষণের জন্য যে পত্রিকাগুলো নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হলো প্রথম আলো, আমাদের সময়, সমকাল, যুগান্তর, বণিক বার্তা, দ্য ডেইলি স্টার, আজকের পত্রিকা, আমার দেশ ও কালের কণ্ঠ।
১ ডিসেম্বর ২০২৫-এ চয়নকৃত ৯টি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে যুগান্তর, ডেইলি স্টার ও কালের কণ্ঠ লিড নিউজ করেছে। বণিকবার্তা ও আজকের পত্রিকার সেকেন্ড লিড ছিল এটি। প্রথম পৃষ্ঠার লোয়ার ফোল্ডে খবরটিকে রেখেছে প্রথম আলো, আমাদের সময় ও সমকাল। সেদিন কোনো পত্রিকাই এ বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেনি। তবে পরদিন, ২ ডিসেম্বর, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ ও আমার দেশ এই বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
প্রতিবেদন উপস্থাপনার দিক থেকেও পত্রিকাগুলোর মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। আমার দেশ ও যুগান্তর তাদের সংবাদে শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করেছে। আমার দেশ ও আজকের পত্রিকা দিয়েছে তাপসের ছবি। অন্য সব পত্রিকাই ঘটনাটির প্রেক্ষাপট হিসেবে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ছবি ব্যবহার করেছে। পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বড় করে, ৫ কলামে ছাপিয়েছে আমার দেশ। বাকিগুলোর মধ্যে ৩ কলামে চারটি পত্রিকা ও ২ কলামে অন্য চারটি পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে।
সব পত্রিকার শিরোনামেই আওয়ামী লীগ জড়িত থাকার উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে ৬টি পত্রিকার শিরোনামে সরাসরি শেখ হাসিনার নাম আসে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া, তাপসের সমন্বয়ের ভূমিকা, তৎকালীন সেনাপ্রধানের আচরণ, ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা এবং কিছু গণমাধ্যমের অপেশাদারিত্ব—এসব বিষয়ও বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সংবাদ প্রতিবেদন
প্রথম আলোর ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডে আ.লীগ দলগতভাবে জড়িত’ শীর্ষক সংবাদে মূল সমন্বয়কারী শেখ ফজলে নূর তাপস এবং পুরো ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল- বলে সাব হেডে উল্লেখ করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনের বরাতে ভারতের জড়িত থাকা এবং কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে বলা হয়।
২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানেরা, এরকম একটা ফাইল ছবি যুক্ত করা হয়।
আমাদের সময় পত্রিকার ‘মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা, সমন্বয়কারী তাপস’ শীর্ষক সংবাদে হত্যাকাণ্ডে দলগতভাবে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা এবং মূল সমন্বয়কারী হিসেবে তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপসের কথা উল্লেখ করা হয়। হত্যাকাণ্ডে প্রতিবেশী দেশ ভারতের জড়িত থাকারও প্রমাণ, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পর্বতসমান গোয়েন্দা ব্যর্থতা, শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং সেনাবাহিনী, বিডিআরসহ অন্য বাহিনীগুলোকে দুর্বল করাই ছিল বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য। আর হত্যা ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের হাত থাকার বিষয়ও প্রতিবেদনে রয়েছে।
একজন নিহত বিডিয়ার জওয়ানকে জড়িয়ে ধরে স্বজনের কান্নার ফাইল ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
দৈনিক সমকাল ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সবুজ সংকেত দেন শেখ হাসিনা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে তাপসের ভূমিকা নিয়ে লেখা হয়। এ ছাড়া বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং কিছু গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের ভূমিকা অপেশাদার ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে তৎকালীন সেনপ্রধানের দায় ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নিয়েও লেখা হয়।
প্রতিবেদনের ভিতরে “সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিডিআর হত্যাকাণ্ড: তদন্ত কমিশন” শীর্ষক পয়েন্টে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ লেখা হয়।
যুগান্তরের শিরোনাম ছিল “বহিঃশক্তি ও আ.লীগ জড়িত”। খবরের সাথে হাসিনা, তাপস ও বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিনের ছবি দেয়া হয়। এছাড়া দ্বিতীয় পাতায় এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ছবি দেওয়া হয়। পুরো সংবাদ বিশ্লেষন করে দেখা যায়, প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনুস, কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব) আ ল ম ফজলুর রহমান, সদস্য জাহাঙ্গীর কবির তালুকদারের বক্তব্য উপস্থাপন করার মাধ্যমে প্রতিবেদনের সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে।
সংবাদের শিরোনামে ও মূল প্রতিবেদনে বহিঃশক্তির জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করলেও কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আওয়ামী লীগ নেতারা আশ্র্রয় দেওয়া ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের দায় থাকার কথা, ঘটনার সময় কিছু প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও কয়েকজন সাংবাদিকের ভুমিকা অপেশাদার ছিল, ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়।
বণিকবার্তা “বিডিআর হত্যাকাণ্ডে দলগতভাবে জড়িত আওয়ামী লীগ, মূল সমন্বয়কারী তাপস” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে। শোল্ডারে লিখেছে, “প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের প্রতিবেদন জমা”। প্রতিবেদনে কমিশন প্রধানের বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরা হয়। সেনাপ্রধান ও ভারতের ভূমিকা এসব বক্তব্যে উঠে আসে।
ডেইলি স্টার উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে ‘Hasina, AL leaders behind BDR mutiny’ শিরোনামে লিড নিউজ করেছে। সাবহেড ও প্রতিবেদনের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড থেকে ভারত “উপকৃত” ছিল বলে তদন্ত কর্মকর্তার বরাতে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনেও আওয়ামীলীগ ও তৎকালীন সেনাপ্রধানের ভূমিকা বিষয়ে তদন্ত কমিশনের বরাতে উদ্ধৃতি দেয়া হয়।
দৈনিক আজকের পত্রিকার শিরোনাম ছিল “প্রধান সমন্বয়ক তাপস, গ্রিন সিগন্যাল দেন শেখ হাসিনা”। এতে তাপসের ছবি দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল, তদন্ত কমিশনের এই ভাষ্যটি আজকের পত্রিকা’র প্রতিবেদনে গুরুত্ব পায়।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়ে আজকের পত্রিকার প্রতিবেদনে কিছু লেখা হয়নি।
কালের কণ্ঠ “হাসিনাসহ ভারতীয়রা জড়িত” শিরোনামে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাবহেডে লিখেছে, দলগতভাবে জড়িত আ. লীগ, মূল সমন্বয়কারী ছিলেন তাপস, জেনারেল মইনেরও দায় আছে। প্রধান উপদেষ্টা ও তদন্ত কমিশনের বিভিন্ন সদস্যবৃন্দের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হয়। এসব বক্তব্যে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ, আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা ও ভারতের ভূমিকা উঠে আসে।
আমার দেশ “ভারত আ.লীগ হাসিনা জড়িত তাপস মূল সমন্বয়কারী” শিরোনামে ৫ কলাম জুড়ে খবর প্রকাশ করেছে। ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে পত্রিকাটি লিখেছে, “ঘটনায় ভারতের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণও পাওয়া গেছে। দেশটির হুমকির কারণে ঘটনার পর পিলখানায় অভিযান পরিচালনা করা যায়নি।”
অন্যান্য পত্রিকা তদন্তে উঠে সাংবাদিকদের অপেশাদার আচরণের কথা উল্লেখ করলেও, আমার দেশ আরেকটু বিস্তারিতভাবে লিখেছে, “প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জঙ্গিতত্ত্ব আবিষ্কার করেছিল। সাংবাদিক মুন্নি সাহা, জ ই মামুন ও মনজুরুল আহসান বুলবুলের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে।”
সম্পাদকীয়
২ ডিসেম্বর যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, ও আমার দেশে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
দৈনিক যুগান্তর “তদন্ত কামশনের রিপোর্ট: পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আলোর দিশা” শিরোনামে সম্পাদকীয় ছেপেছে। এতে মন্তব্য করা হয়েছে, “জাতি দীর্ঘদিন ধরে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের সত্য জানতে উদগ্রীব ছিল। মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের প্রতিবেদন সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে।” এ ছাড়াও তদন্ত কমিশন ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে ভারতের কাছে জবাব চাওয়ার যে সুপারিশ করেছে, তা “তদন্তের স্বার্থে যথার্থই” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়নের উপর জোর দেয়া হয় সম্পাদকীয়তে।
কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়র শিরোনাম “প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি হোক”। এতে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, “আমরা আশা করি, জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পিলখানায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত দোষীদের দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে আনা হবে এবং বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে।”
আমার দেশ পত্রিকা “বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িত ভারত-আওয়ামী লীগ: এবার জড়িতদের বিচার করতে হবে” এমন শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এতে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, “বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সাহসী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ভয়াবহতম গণহত্যা সম্পর্কে জাতির মনে যেসব প্রশ্ন ছিল, তা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।” পাশাপাশি জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয় সম্পাদকীয়তে।