| এক্সপ্লেইনার
অন্তর্বর্তী আমলে অপরাধ সূচকে দুই দাগে উন্নতি, এক দাগে অবনতি। তবে...
৬ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা বাড়লেও এ সরকারের শাসনামলে হত্যা ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধের হার কমেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যানের তুলনা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে দেখা গেছে, যদিও সেসব পরিসংখ্যান ও তুলনা বাস্তব পরিস্থিতিকে সামান্যই প্রতিফলিত করেছে।
আল জাজিরা টেলিভিশনের ইংরেজি ওয়েবসাইটে গত ৪ মার্চ ২০২৫-এ প্রকাশিত ‘Gotham but no Batman’: Crime grips Bangladesh 6 months after Hasina fled শিরোনামের সংবাদে এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছে যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের দিকে। সংবাদটিতে গত ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত ২৩১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাথে এ বছরে সংঘটিত ২৯৪টি ঘটনার তুলনা করে দাবি করা হয়েছে যে, গত পাঁচ মাসে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে।
অথচ কেবল দু বছরের একটি (জানুয়ারি) মাসে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যার তুলনা করে সারা বছরের অপরাধের মাত্রা বোঝা কতটা সম্ভব বা বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্নের সুযোগ থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৪ সালের এপ্রিলে ২৯৬ টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অন্তত ১৭টি মাসের প্রতিটিতে ২৯৪ বা এর বেশি সংখ্যক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গড় হিসেবে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত পাঁচ মাসের প্রতিমাসে গড় হত্যার সংখ্যা ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যেকোনো মাসে সংঘটিত হত্যা সংখ্যার চেয়ে কম।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উল্লিখিত পাঁচ মাস সময়ে ধর্ষণের হারও কমেছে। যেখানে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগের ছয় মাসে ধর্ষণের মোট সংখ্যা ছিল ২৬৩; সেখানে পরের ছয় মাসে তা কমে হয়েছে মোট ১৪৮। তবে পুলশের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রতিমাসে গড়ে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে।
হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতির এই পরিসংখ্যানগুলো মূলত থানায় দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে তৈরী করা হয়। ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড একটি সংবাদে জানায়, প্রাক্তন আইজিপি জাভেদ পাটোয়ারির আমলে উচ্চ ও মধ্যম পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার সুপারিশে পুলিশের ওয়েবসাইটে অপরাধ পরিসংখ্যান আপলোড ও প্রকাশ বন্ধ করা হয়েছিল। ফলে এই আশঙ্কাও থেকে যায় যে, পরিসংখ্যান তৈরির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল।
ঢাকায় প্রায় দু দশক অপরাধবিষয়ক সংবাদ কভার করা এক সংবাদকর্মী জানান, ‘বিগত সরকারের আমলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ অপরাধ সংক্রান্ত তথ্যগুলো গোপন রাখতে শুরু করে।’
‘পরে বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর, সাংবাদিকেরা এক আলাপচারিতায় মাননীয় আইজিপি মহোদয়কে জানান যে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের অপরাধ পরিসংখ্যান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দেশের যেকোনো স্থান থেকে অপরাধের সংখ্যা জানা বা এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার অধিকারী প্রতিটি নাগরিক। তাই অবিলম্বে সেসব তথ্য জনগণ ও গণমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। কারণ এ ধরনের তথ্য গোপন করলে নাগরিকেরা অধিকার বঞ্চিত হয়,’ বলছিলেন ওই সংবাদকর্মী।
এছাড়া, পুলিশ-প্রশাসনের ওপরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং দলের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের ফলে অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করতে পারেনি বা অভিযোগ দায়ের করতে অনুৎসাহিত হয়েছিল। এর ফলে পুলিশের খাতায় অপরাধের সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম দেখা যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর জুলাইয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও পরিসংখ্যানে মাত্র ৩৩৪টি হত্যা দেখানো হয়েছে, যা প্রকৃত সংখ্যা থেকে অনেক কম। বর্তমান সরকারের সময়ে এ ব্যাপারে কোনো বাধাবিপত্তি না থাকায়, ভুক্তভোগীরা স্বাধীনভাবে অভিযোগ ও মামলা করতে পারছে, ফলে পরিসংখ্যানেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও পুলিশের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়
, নতুন সরকারের আমলে ধর্ষণ ও হত্যার সংখ্যা কমেছে, কিন্তু ছিনতাই-ডাকাতি বেড়েছে। তাই এটি স্পষ্ট যে কেবল সরকারি পরিসংখ্যান দিয়ে আইনশৃঙ্খলার প্রকৃত অবস্থা বিচার করা যায় না।
আপনার মতামত দিন
এই পোস্টটি কি আপনার জন্য সহায়ক ছিল?
আপনার মতামত শেয়ার করুন:

এক্সপ্লেইনার
অন্তর্বর্তী আমলে অপরাধ সূচকে দুই দাগে উন্নতি, এক দাগে অবনতি। তবে...
৬ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা বাড়লেও এ সরকারের শাসনামলে হত্যা ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধের হার কমেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যানের তুলনা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে দেখা গেছে, যদিও সেসব পরিসংখ্যান ও তুলনা বাস্তব পরিস্থিতিকে সামান্যই প্রতিফলিত করেছে।
আল জাজিরা টেলিভিশনের ইংরেজি ওয়েবসাইটে গত ৪ মার্চ ২০২৫-এ প্রকাশিত ‘Gotham but no Batman’: Crime grips Bangladesh 6 months after Hasina fled শিরোনামের সংবাদে এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছে যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের দিকে। সংবাদটিতে গত ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত ২৩১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাথে এ বছরে সংঘটিত ২৯৪টি ঘটনার তুলনা করে দাবি করা হয়েছে যে, গত পাঁচ মাসে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে।
অথচ কেবল দু বছরের একটি (জানুয়ারি) মাসে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যার তুলনা করে সারা বছরের অপরাধের মাত্রা বোঝা কতটা সম্ভব বা বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্নের সুযোগ থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৪ সালের এপ্রিলে ২৯৬ টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অন্তত ১৭টি মাসের প্রতিটিতে ২৯৪ বা এর বেশি সংখ্যক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গড় হিসেবে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত পাঁচ মাসের প্রতিমাসে গড় হত্যার সংখ্যা ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যেকোনো মাসে সংঘটিত হত্যা সংখ্যার চেয়ে কম।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উল্লিখিত পাঁচ মাস সময়ে ধর্ষণের হারও কমেছে। যেখানে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগের ছয় মাসে ধর্ষণের মোট সংখ্যা ছিল ২৬৩; সেখানে পরের ছয় মাসে তা কমে হয়েছে মোট ১৪৮। তবে পুলশের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রতিমাসে গড়ে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে।
হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতির এই পরিসংখ্যানগুলো মূলত থানায় দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে তৈরী করা হয়। ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড একটি সংবাদে জানায়, প্রাক্তন আইজিপি জাভেদ পাটোয়ারির আমলে উচ্চ ও মধ্যম পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার সুপারিশে পুলিশের ওয়েবসাইটে অপরাধ পরিসংখ্যান আপলোড ও প্রকাশ বন্ধ করা হয়েছিল। ফলে এই আশঙ্কাও থেকে যায় যে, পরিসংখ্যান তৈরির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল।
ঢাকায় প্রায় দু দশক অপরাধবিষয়ক সংবাদ কভার করা এক সংবাদকর্মী জানান, ‘বিগত সরকারের আমলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ অপরাধ সংক্রান্ত তথ্যগুলো গোপন রাখতে শুরু করে।’
‘পরে বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর, সাংবাদিকেরা এক আলাপচারিতায় মাননীয় আইজিপি মহোদয়কে জানান যে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের অপরাধ পরিসংখ্যান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দেশের যেকোনো স্থান থেকে অপরাধের সংখ্যা জানা বা এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার অধিকারী প্রতিটি নাগরিক। তাই অবিলম্বে সেসব তথ্য জনগণ ও গণমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। কারণ এ ধরনের তথ্য গোপন করলে নাগরিকেরা অধিকার বঞ্চিত হয়,’ বলছিলেন ওই সংবাদকর্মী।
এছাড়া, পুলিশ-প্রশাসনের ওপরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং দলের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের ফলে অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করতে পারেনি বা অভিযোগ দায়ের করতে অনুৎসাহিত হয়েছিল। এর ফলে পুলিশের খাতায় অপরাধের সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম দেখা যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর জুলাইয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও পরিসংখ্যানে মাত্র ৩৩৪টি হত্যা দেখানো হয়েছে, যা প্রকৃত সংখ্যা থেকে অনেক কম। বর্তমান সরকারের সময়ে এ ব্যাপারে কোনো বাধাবিপত্তি না থাকায়, ভুক্তভোগীরা স্বাধীনভাবে অভিযোগ ও মামলা করতে পারছে, ফলে পরিসংখ্যানেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও পুলিশের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়
, নতুন সরকারের আমলে ধর্ষণ ও হত্যার সংখ্যা কমেছে, কিন্তু ছিনতাই-ডাকাতি বেড়েছে। তাই এটি স্পষ্ট যে কেবল সরকারি পরিসংখ্যান দিয়ে আইনশৃঙ্খলার প্রকৃত অবস্থা বিচার করা যায় না।