| বিশ্লেষণ

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংগঠিত মিথ্যাচারের খতিয়ান

৪ জুন ২০২৫



৩ জুন মঙ্গলবার রাতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন), ২০২৫’ জারি করে। অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়। তবে এতে মুক্তযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি বাতিলে প্রসঙ্গ ছিল না। কিন্তু অধ্যাদেশটি জারির পরপরই রাত ১১ টা ৪৪ মিনিটে দৈনিক সমকাল তাদের অনলাইন সংস্করণে “বঙ্গবন্ধুসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল” শীর্ষক সম্পূর্ণ বিপরীত শিরোনামে সংবাদ প্র্রকাশ করে। এর পরে মূলধারার বিভিন্ন পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন একইভাবে অধ্যাদেশটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে। “শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার স্বীকৃতি বাতিল” কিংবা "মুজিবনগর সরকারের সব নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল" ইত্যাদি শিরোনামে সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে।

সমকাল, ইত্তেফাক, যুগান্তর, বিডিনিউজ২৪, আমাদের সময়, বাংলানিউজ২৪, ইনকিলাব, নিউজ২৪, এখন টিভি, বাংলা ট্রিবিউন, দৈনিক বাংলা, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, ঢাকা মেইল, ঢাকা পোস্ট, ঢাকা টাইমস২৪, খবরের কাগজ, বাংলা ট্রিবিউন, দেশ টিভি, কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনুরূপ খবর প্রকাশ করা হয়। এতগুলো গণমাধ্যম কেন একযোগে এভাবে সংবাদ প্রকাশ করল, কীভাবেই বা ছড়াল এটি?

বাংলাফ্যাক্ট অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, দৈনিক সমকালের অনলাইন ভার্সন প্রথম এই ভুয়া সংবাদটি ০৩ জুন রাত ১১টা ৪৪ মিনিটে প্রকাশ করেছে। দৈনিক কালের কণ্ঠ ও বিবিসি বাংলাও মূল অধ্যাদেশটি যাচাই না করেই সমকালের বরাতে সংবাদ প্রকাশ করে। পত্রিকাটির মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিটের সাংবাদিক আবু সালেহ রনি এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত ২১ মার্চেও সমকালে “মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার” শিরোনামে সমকাল এই সাংবাদিকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটির ওপর ভিত্তি করে বিডিনিউজ২৪-এ একটি মতামতও প্রকাশিত হয়। ৩ জুন প্রকাশিত অধ্যাদেশটিকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে যেসব ভুয়া রিপোর্ট প্রচারিত হয়েছে, তার ভিত্তি হিসেবে ওই রিপোর্টটি কাজ করে থাকতে পারে।

উল্লেখ্য, আবু সালেহ রনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) থেকে ২০২৪ এর নভেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজের জন্য পুরষ্কার লাভ করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ডিআরইউ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ৬টিসহ মোট ১১টি পুরষ্কার পেয়েছেন। মাসে। ফেসবুকে শেখ হাসিনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো, প্রোফাইল পিকচারে “We all are Sheikh Hasina’s Men” দেয়াসহ ফেসবুকে তার কর্মকাণ্ড থেকে ধারণা করা যায়, তিনি শেখ হাসিনার সমর্থক ছিলেন। জুলাই হত্যাযজ্ঞেও তাঁর নামে মামলা রয়েছে। তিনি বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সাংবাদিক মহলে পরিচিতি। আবু সালেহ রনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সর্বশেষ কমিটির প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক।

অধ্যাদেশে আসলে কী আছে, অপতথ্যের উদ্দেশ্যই বা কী?

জারিকৃত অধ্যাদেশে দেখা গিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেখানে স্পষ্টত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রবাসী (মুজিবনগর) সরকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাঁদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

অধ্যাদেশে স্পষ্টত উল্লেখ করা থাকলেও, এমনকি সমকালসহ অধিকাংশ পত্রিকা তাদের সংবাদের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সঠিকভাবে তুলে ধরলেও, তারা যেভাবে সংবাদগুলো সাজিয়েছে এবং পরিবেশন করেছে নতাতে বর্তমানে জারিকৃত অধ্যাদেশকে ‘মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী’ হিসাবে দেখানোর প্রয়াস রয়েছে।

২০২২ সালের অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা’র সাথে বর্তমান অধ্যাদেশের তুলনা

মুজিবনগর সরকারের অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারি বা দূত এবং মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত সকল এমএনএ বা এমপিএ, যারা পরববর্তীতে ১৯৭২ সালের গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন তারা আগেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন। নতুন সংজ্ঞায় মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং এমএনএ বা এমপিএ-দের ‘মুক্তিযোদ্ধা’র বদলে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞাকে আওয়ামী লীগ যেভাবে দলীয়করণ করেছিল, সেটাকেও রদ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে চলতি অধ্যাদেশে। ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া’ কথাটি উল্লেখ ছিল। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ‘জনযুদ্ধের’ ইতিহাসকে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে পরিণত করার প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় সে স্থলে ‘একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা’-র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, নতুন অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের দলীয় বয়ানের বাইরে এনে জনগোষ্ঠীর জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে দেখাবার প্রয়াস রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার পরিধি যেভাবে খেয়ালখুশিমতো বাড়িয়েছিল, তাতে প্রবাসীরা সহ অনেক অবান্তর ও সেসময়ে নাবালক ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া শুরু করেছিলেন। এই অধ্যাদেশে সেই পরিধি কমিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে রাজনীতির সুযোগ সীমিত করা হয়েছে।

আপনার মতামত দিন

এই পোস্টটি কি আপনার জন্য সহায়ক ছিল?

আপনার মতামত শেয়ার করুন:




বিশ্লেষণ

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংগঠিত মিথ্যাচারের খতিয়ান

৪ জুন ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংগঠিত মিথ্যাচারের খতিয়ান

৩ জুন মঙ্গলবার রাতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন), ২০২৫’ জারি করে। অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়। তবে এতে মুক্তযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি বাতিলে প্রসঙ্গ ছিল না। কিন্তু অধ্যাদেশটি জারির পরপরই রাত ১১ টা ৪৪ মিনিটে দৈনিক সমকাল তাদের অনলাইন সংস্করণে “বঙ্গবন্ধুসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল” শীর্ষক সম্পূর্ণ বিপরীত শিরোনামে সংবাদ প্র্রকাশ করে। এর পরে মূলধারার বিভিন্ন পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন একইভাবে অধ্যাদেশটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে। “শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার স্বীকৃতি বাতিল” কিংবা "মুজিবনগর সরকারের সব নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল" ইত্যাদি শিরোনামে সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে।

সমকাল, ইত্তেফাক, যুগান্তর, বিডিনিউজ২৪, আমাদের সময়, বাংলানিউজ২৪, ইনকিলাব, নিউজ২৪, এখন টিভি, বাংলা ট্রিবিউন, দৈনিক বাংলা, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, ঢাকা মেইল, ঢাকা পোস্ট, ঢাকা টাইমস২৪, খবরের কাগজ, বাংলা ট্রিবিউন, দেশ টিভি, কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনুরূপ খবর প্রকাশ করা হয়। এতগুলো গণমাধ্যম কেন একযোগে এভাবে সংবাদ প্রকাশ করল, কীভাবেই বা ছড়াল এটি?

বাংলাফ্যাক্ট অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, দৈনিক সমকালের অনলাইন ভার্সন প্রথম এই ভুয়া সংবাদটি ০৩ জুন রাত ১১টা ৪৪ মিনিটে প্রকাশ করেছে। দৈনিক কালের কণ্ঠ ও বিবিসি বাংলাও মূল অধ্যাদেশটি যাচাই না করেই সমকালের বরাতে সংবাদ প্রকাশ করে। পত্রিকাটির মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিটের সাংবাদিক আবু সালেহ রনি এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত ২১ মার্চেও সমকালে “মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার” শিরোনামে সমকাল এই সাংবাদিকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটির ওপর ভিত্তি করে বিডিনিউজ২৪-এ একটি মতামতও প্রকাশিত হয়। ৩ জুন প্রকাশিত অধ্যাদেশটিকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে যেসব ভুয়া রিপোর্ট প্রচারিত হয়েছে, তার ভিত্তি হিসেবে ওই রিপোর্টটি কাজ করে থাকতে পারে।

উল্লেখ্য, আবু সালেহ রনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) থেকে ২০২৪ এর নভেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজের জন্য পুরষ্কার লাভ করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ডিআরইউ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ৬টিসহ মোট ১১টি পুরষ্কার পেয়েছেন। মাসে। ফেসবুকে শেখ হাসিনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো, প্রোফাইল পিকচারে “We all are Sheikh Hasina’s Men” দেয়াসহ ফেসবুকে তার কর্মকাণ্ড থেকে ধারণা করা যায়, তিনি শেখ হাসিনার সমর্থক ছিলেন। জুলাই হত্যাযজ্ঞেও তাঁর নামে মামলা রয়েছে। তিনি বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সাংবাদিক মহলে পরিচিতি। আবু সালেহ রনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সর্বশেষ কমিটির প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক।

অধ্যাদেশে আসলে কী আছে, অপতথ্যের উদ্দেশ্যই বা কী?

জারিকৃত অধ্যাদেশে দেখা গিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেখানে স্পষ্টত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রবাসী (মুজিবনগর) সরকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাঁদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

অধ্যাদেশে স্পষ্টত উল্লেখ করা থাকলেও, এমনকি সমকালসহ অধিকাংশ পত্রিকা তাদের সংবাদের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সঠিকভাবে তুলে ধরলেও, তারা যেভাবে সংবাদগুলো সাজিয়েছে এবং পরিবেশন করেছে নতাতে বর্তমানে জারিকৃত অধ্যাদেশকে ‘মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী’ হিসাবে দেখানোর প্রয়াস রয়েছে।

২০২২ সালের অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা’র সাথে বর্তমান অধ্যাদেশের তুলনা

মুজিবনগর সরকারের অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারি বা দূত এবং মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত সকল এমএনএ বা এমপিএ, যারা পরববর্তীতে ১৯৭২ সালের গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন তারা আগেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন। নতুন সংজ্ঞায় মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং এমএনএ বা এমপিএ-দের ‘মুক্তিযোদ্ধা’র বদলে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞাকে আওয়ামী লীগ যেভাবে দলীয়করণ করেছিল, সেটাকেও রদ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে চলতি অধ্যাদেশে। ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া’ কথাটি উল্লেখ ছিল। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ‘জনযুদ্ধের’ ইতিহাসকে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে পরিণত করার প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় সে স্থলে ‘একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা’-র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, নতুন অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের দলীয় বয়ানের বাইরে এনে জনগোষ্ঠীর জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে দেখাবার প্রয়াস রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার পরিধি যেভাবে খেয়ালখুশিমতো বাড়িয়েছিল, তাতে প্রবাসীরা সহ অনেক অবান্তর ও সেসময়ে নাবালক ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া শুরু করেছিলেন। এই অধ্যাদেশে সেই পরিধি কমিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে রাজনীতির সুযোগ সীমিত করা হয়েছে।